stop sexual harassmentসর্বশেষ সরকারী তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে দিনে গড়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১৪০টি। আর এ ঘটনায় ধর্ষণ মামলা হচ্ছে গড়ে ৯টি।

জানুয়ারি ২৫, ২০১৫ তারিখে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সংসদে দেওয়া তথ্যে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।

গত ৫ বছরের নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলা প্রসঙ্গে সরকার দলীয় মহিলা সংসদ সদস্য মিসেস আমিনা আহমেদের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী জানান, গত পাঁচ (২০০৯-১৪) বছরে দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫২টি।

এসব নির্যাতনের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ষণ মামলা রয়েছে ১৬ হাজার ৭৭৪টি।

প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্যের হিসাবে দেখা যায়, দিনে গড় নারী নির্যাতনের সংখ্যা ১৪১ দশমিক ৪০টি এবং ধর্ষণ মামলার সংখ্যা গড়ে ৯.২টি।

Reported rape incidents in 2015 (Jan-May 23) — 241, 2014 — 789, 2013 — 719, 2012 — 836, 2011 — 603, 2010 — 411. (Source: Bangladesh National Women Lawyers’ Association)

জাতিসংঘের তথ্য মতে, বাংলাদেশে স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন ৪৭ শতাংশ নারী।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় গত জানুয়ারি থেকে মার্চ এই সময়ে অন্ততঃ ৪০ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং ২০ জন পুরুষ প্রতিবাদ করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন।

একই সময়ে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ৫৮ জন নারী, আর শশুরবাড়ির সদস্যদের দ্বারা আরো ১০ জন। এই সময়ে আত্মহত্যার কমপক্ষে ১৬ টি ঘটনা প্রকাশিত হয়।

গতবছর সারা দেশে প্রকাশিত পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪৮৮ টি যেখানে ২৬২ জন স্বামীর ও ৭৯ জন অন্য সদস্যদের দ্বারা নির্যাতনে মারা গেছেন। এ সময়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ৮৪ টি।

কিছু মামলা হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দেশে প্রতি বছর হাজারো মামলা হলেও মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা পাওয়ার হার এক শতাংশেরও কম। দেশের তিনটি জেলায় ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৭৩টি মামলার নিষ্পত্তি হলেও এতে সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৯৪ শতাংশ।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা ও পাবনা জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের মামলা পর্যালোচনা করে তারা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে ঢাকা, কুমিল্লা ও পাবনা জেলায় বিচারাধীন মামলা ছিল ৮ হাজার ৭২৭টি। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৭৪-এ। এ সময়ে মোট মামলা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯১৫টি।

ছয় বছরে মোট মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২২ হাজার ৭৩টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ২ হাজার ৬০৮ টি,২০১০ সালে ২ হাজার ৬৪২ টি,২০১১ সালে ৩ হাজার ৩২ টি,২০১২ সালে ৪ হাজার ২৭৯ টি,২০১৩ সালে ৪ হাজার ৯৭০টি এবং ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫৪২টি।

নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৫৪ জন, ২০১০ সালে ৪৮ জন, ২০১১ সালে ২৩ জন, ২০১২ সালে ২৭ জন, ২০১৩ সালে ১৫ এবং ২০১৪ সালে ১৯ জন। ২০০৯ সালে সাজা পাওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪০ শতাংশে।

একই সময়ে মামলা থেকে খালাস পান ১২ হাজার ৫৪ জন। ২০০৯ সালে মামলা থেকে খালাস পাওয়ার হার ছিল ৯৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ৬০ শতাংশে।

২০০৯ সালে মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশে। সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৯৭০টি (২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ) মামলা নিষ্পত্তি ২০১৩ সালে।

প্রথম আলোর একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন খুবই ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেছেঃ গত ১৪ বছরে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় ঢাকায় সরকার পরিচালিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) এসেছেন ৫ হাজার ৩২১ জন নারী। সাজা হয়েছে ৪৩ জনের।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল শের-ই-বাংলা, খুলনা, সিলেট এম এ জি ওসমানী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২ হাজার ৩৮৬ জন ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসেন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার তিনটি। রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ।

এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ধর্ষণের অন্তত ৩০টি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ধর্ষণের শিকার ১৫ জন ছিল শিশু।

এর বাইরে সংখ্যালঘু, দলিত জনগোষ্ঠীর বাসিন্দা, বিধবা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শ্রমজীবী নারী বাসে, ট্রাকে এমনকি নৌকায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষকেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারের স্বজন, স্কুল কমিটির প্রধান, শিক্ষক, সশস্ত্র সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসীর সন্তান।

দেশের প্রধান বিচারপতির সর্বশেষ মন্তব্যের পর আমাদের আরো ভাবতে হবে আমরা কোন পথে যাচ্ছি।

সম্প্রতি গাজীপুরে নারী ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গাজীপুরে অনেক যুবতী মেয়েকে ৫৪ ধারায় আটক রাখা হয়েছে। তাদের আদালতে হাজির করা হয় না। জেলা জজকে এ বিষয়টি তদন্ত করে তালিকাসহ রিপোর্ট দিতে বলেছি। জেলা জজ জানিয়েছেন, মেয়েদের আদালতে উপস্থাপন করা হয় না। কারণ তাদের যৌন কাজে ব্যবহার করা হয়। তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে (ড. মিজানুর রহমান) সুপ্রিম কোর্টে আমার কার্যালয়ে ডেকে এনে লিস্টসহ ওইসব নারীর তালিকা দিয়েছিলাম। অনেক দিন হয়ে গেছে, দেখার মতো কিছুই হয়নি।’

আমি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর সিলেটে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রধান কাজ ছিল সেন্ট্রাল জেল ভিজিট (পরিদর্শন) করা। ভিজিটে গিয়ে যা দেখলাম তা লোমহর্ষক ঘটনা। একেবারেই তরুণী মেয়েরা সেখানে বন্দি রয়েছে। আমি আরো জানতে পারলাম, ১৫-২০ জন নারী বিভিন্ন সাজা পেয়ে কারাভোগ করছেন। তাদের আইনি সহায়তা দেওয়ার মতো কেউ নেই। নারীরা কি পরিমাণে নিগৃহীত হচ্ছে, তা ভাষায় বলার মতো না।

তিনি বলেন, ঢাকা, গাজীপুর, সিলেট কারাগারে নারী বন্দিরা অনেক অব্যবস্থাপনার মধ্যে জীবন যাপন করছেন। তিনি বলেন, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়াতেও এদেশের অনেক নারী-শিশু বিভিন্নভাবে আটক রয়েছে।

গাজীপুরে মহিলা ও শিশুকেন্দ্রে অনেক তরুণী নারীকে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে এমন তথ্য প্রকাশ করে তিনি বলেন, তাদেরকে শুধু আটকে রাখা হয়নি তাদের যৌন নিগৃহীত করা হচ্ছে। টাকা-পয়সা নেই এমন গরিব অসহায় নারীদের পক্ষে মাসে দু’একটি করে মামলা পরিচালনা করে সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য আইনজীবীদের প্রতি আহবান জানান প্রধান বিচারপতি।

নারী নির্যাতন রোধে সাক্ষ্য আইনের একটি ধারাকে সংশোধন করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। আমাদের সাক্ষ্য আইন এতো ভালো। তবে এর কিছু ধারা আছে যা ঔপনিবেশিক চিন্তা চেতনার আইন। তখন জনগণের কথা চিন্তা করে এ আইন করা হয়নি। এই কালো বিধানগুলো আইন থেকে তুলে দেওয়া উচিত।

‘নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক যুগান্তকারী রায়: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান’ শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অনুসারে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা’।

প্রধান বিচারিপতি এ ধারাটি উল্লেখ করে বলেন, আমাদের আইনের এক জায়গায় বলা আছে, কারো চরিত্র নিয়ে কথা বলা যাবে না, প্রশ্নও করা যাবে না। কিন্তু নারী নির্যাতন মামলার সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারার একটিতে বলা আছে, যদি কোনো নারী কোনো ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, তাহেলে সে নারীর চরিত্র নিয়ে কথা বলা যাবে।

তিনি বলেন, একজন নারীর সম্ভ্রম নষ্ট হলো, তিনি বিচার প্রার্থী। তার চরিত্র নিয়ে আসামি প্রশ্ন করবেন সবার সামনে এর চেয়ে দু:খজনক আর কি হতে পারে? এ আইনটি সংশোধনের জন্য নারীনেত্রীদের দাবি তোলার আহবান জানান প্রধান বিচারপতি, যা ভারতে অনেক আগেই সংশোধন করা হয়েছে।

আমরা একটু সুস্থ সমাজ চাই, আইনের শাসন ও পুরুষদের আত্মনিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে যা নিশ্চিত করা সম্ভব।